উন্নত ও খাটো (ওপি) জাতের নারিকেল চাষ পদ্ধতি
নারিকেল বাংলাদেশের অন্যতম এক বৃক্ষ যার প্রতিটি
অংগ জনজীবনে কোনো না কোনোভাবে কাজে আসে। এ গাছের পাতা, ফুল, ফল, কাণ্ড, শিকড়
সব কিছুই বিভিন্ন ছোট-বড় শিল্পের কাঁচামাল, হরেক রকম মুখরোচক খাবার তৈরির উপকরণ, সুস্বাদু
পানীয় ও রোগীর পথ্য হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। এটি পৃথিবীর অপূর্ব গাছ, তথা ‘স্বর্গীয়
গাছ' হিসাবে সবার কাছে সমাদৃত ও সুপরিচিত ।
আমাদের দেশে নারিকেলের যেসব জাতের প্রচলন আছে সেগুলো মূলত লম্বা
জাতের, ফলন তুলনামূলকভাবে কম, ফল প্রাপ্তির সংখ্যা গড়ে বছরে
সর্বোচ্চ ৩০-৪০টা । দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে আগে থেকেই লম্বা জাতের নারিকেল চাষের
প্রচলন আছে । বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে এগুলোর ঝড়ো হাওয়া, সহ-
নশীলতা কম। পক্ষান্তরে খাটো আধুনিক জাতগুলো অল্প সময়ে ফল দেয়া আরম্ভ করে, ফলদান
ক্ষমতা অনেক বেশি এবং ঝড়ে ভেঙে পড়ে না। নারিকেল গাছের লবণাক্ততা সহিষ্ণু গুণ খুব
বেশি। বর্তমান সরকার দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোর পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর
অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করছে। এসব এলাকায় নারিকেল চাষের জন্য অতি
অনুকূল অবস্থা বিরাজ করছে। এ বিবেচনায় ভিয়েতনাম থেকে খাটো ও উন্নত জাতের নারিকেল
চারা এনে দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে ব্যাপক সম্প্রসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
জাত : ভিয়েতনাম থেকে সংগৃহীত খাটো জাত দুইটি হলো-
ক. সিয়াম গ্রিন কোকোনাট (Dua Xiem Xanh) : ডাব
হিসাবে ব্যবহারের জন্য এ জাতটি অতি জনপ্রিয়। এ জাতের ফলের রঙ সবুজ, আকার
কিছুটা ছোট, প্রতিটির ওজন ১.২-১.৫ কেজি। ডাবের পানির পরিমাণ ২৫০-৩০০ মিলি।
গাছপ্রতি বছরে ফল ধরে গড়ে ১৫০টি।
খ. সিয়াম ব্লু কোকোনাট (Dua Xiem Luc) : এটিও অতি
জনপ্রিয় জাত, এটা ২০০৫ সালে উদ্ভাবন করা হয়। এটা কৃষকের খুব পছন্দের জাত। চারা
রোপণের আড়াই থেকে তিন বছরের মধ্যেই ফল ধরে, ফলের রঙ গাঢ় সবুজ, ওজন
১.২-১.৫ কেজি, ডাবের পানির পরিমাণ ২৫০-৩০০ মিলি। ডাবের পানি অতি মিষ্টি এবং শেলফ
লাইফ বেশি হওয়ার কারণে এ জাতের ডাব বিদেশে রপ্তানি করা যায়। গাছপ্রতি বছরে ফল
ধরে গড়ে ১৫০টি। এ জাতের চারা লাগানোর দুই আড়াই বছরের মধ্যেই ফুল ফোটা আরম্ভ হয়, দেশি
লম্বা জাতের মতো ফুল হতে ৭-৮ বছর সময় লাগে না ।
মাটি : প্রায় সব ধরনের মাটি নারিকে চাষের জন্য উপযোগী। তবে অতি
শক্ত, কাঁকর শিলাময় মাটি হলে প্রায় দেড় মিটার চওড়া ও দেড় মিটার গভীর
করে গর্ত তৈরি করে গর্তটি জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ উপরিভাগের মাটি ও সার দিয়ে ভরাট করে
গাছ লাগালে গাছ সুন্দর ভাবে বেড়ে উঠবে। রোপণ সময় : শুকনা মৌসুমে সেচের সুবিধা
থাকলে অথবা বসতবাড়িতে সারা বছরই রোপণ করা যাবে।
X
রোপণ দূরত্ব : বসতবাড়িতে স্বল্প সংখ্যক গাছ লাগানো হলে ৫ মিটার
দূরত্বই যথেষ্ট। বাগান আকারে ৬ মিটার দূরত্বে রোপণ করা যাবে। ১মি. x ১মি.
মাপের গর্ত তৈরি করা প্রয়োজন । এঁটেল মাটির ক্ষেত্রে গর্তের গভীরতা ঠিক রেখে
চওড়ায় ২০-৩০ সেন্টিমিটার বেশি বাড়াতে হবে। গর্ত তৈরি করে ৪-৫ দিন রোদে রাখার পর
জৈব ও রাসায়নিক সার মিশ্রিত উপরিভাগের মাটি দিয়ে ভরাট করে কয়েক বালতি পানি
দিয়ে রেখে দেয়ার ২-৩ সপ্তাহ বাদে এ মাদায় চারা রোপণ করা যাবে। গর্তের তলায় বা
নিচের স্তরে ১০-১৫ সেন্টিমিটার চওড়া করে নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে ভরাট করা হলে তা
বাতাস চলাচল ও শিকড় ছড়ানোর জন্য সহায়ক হবে।
গর্তে সার প্রয়োগ : পচা গোবর বা আবর্জনা পচা সার ২০-১৫ কেজি, কেঁচো
সার ২ কেজি, হাড়ের গুঁড়া ১ কেজি, নিমের খৈল ৫০০ গ্রাম,টিএসপি
৩০০ গ্রাম, এমওপি ৩৫০ গ্রাম, জিঙ্ক সালফেট ১০০ গ্রাম, বোরন/বোরিক
এসিড ২০০ গ্রাম, ফুরাডান/বাসুডিন ৫০ গ্রাম এবং ম্যানকোজেব দলীয় ছত্রাকনাশক ১০গ্রাম ।
চারা রোপণ : চারা রোপণের জন্য ২৫ সেন্টিমিটার চওড়া ও ৫০
সেন্টিমিটার গভীর গর্ত করে নিয়ে তাতে চারা লাগাতে হবে। এ সময় খেয়াল রাখতে হবে
যেন ক. চারাটি জমি হতে ২০-২৫ সেন্টিমিটার নিচে বসানো হয়, খ.
গোড়ার অংশ কিছুটা উন্মুক্ত থাকবে বা গোড়ার নারিকেলের অংশবিশেষ কিছুটা দেখা যাবে।
নিচু করে লাগানোর কারণে বাইরে থেকে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষার জন্য ৪০১-৫০
সেন্টিমিটার দূরে ১০-১৫ সেন্টিমিটার উঁচু করে চারদিকে বাঁধ দিতে হবে। পুকুরের ধার
বা পাহাড়ের ঢালে চারা লাগানোর ক্ষেত্রে আরও ১০ সেন্টিমিটার নিচে লাগাতে হবে ।
সার প্রয়োগ ও সেচ প্রদান : চারা রোপণের প্রতি ৩ মাস পর পর
নিম্নলিখিত হারে সার প্রয়োগ করতে হয়। চারার গোড়া থেকে ২০ সেন্টিমিটার দূরত্বে
২০ সেন্টিমিটার চওড়া ও ১০ সেন্টিমিটার গভীর নালায় সারগুলো প্রয়োগ করতে হবে।
পরের প্রতিবার চারার গোড়া থেকে আগের বারের চেয়ে ৫-৭ সেন্টিমিটার আরও দূরে সার
প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পর ১৫-২০ লিটার পানি দিয়ে গাছের গোড়া ভেজাতে
হবে।
বি. দ্র. ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ও বোরন সার ৬ মাসের ব্যবধানে বছরে
দুইবার প্রয়োগযোগ্য
পরিচর্যা : নারিকেল বাগান বিশেষ করে গাছের গোড়ার চারধার সব সময়
আগাছামুক্ত রাখতে হবে। প্রথম ২ বছর গাছের গোড়া থেকে ৬০-৭০ সেন্টিমিটার দূরে
বৃত্তাকারে চারিদিকের অংশে কচুরিপানা শুকিয়ে ছোট করে কেটে ৮-১০ সেন্টিমিটার পুরু
করে মালচিং দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পরে ক্রমান্বয়ে পরিধি বাড়িয়ে ২ মিটার দূর
পর্যন্ত ফলন্ত গাছে নিয়মিত মালচিং এর ব্যবস্থা রাখতে হবে। এতে গাছের গোড়া ঠাণ্ডা
থাকবে, আগাছা জন্মাবে না, মাটির রস সংরক্ষিত থাকবে এবং
পরবর্তীতে এগুলো পচে জৈবসার হিসাবে কাজ করবে। তবে এভাবে মালচিং দেয়ার সময় খেয়াল
রাখতে হবে যেন তা গাছের কাণ্ডকে স্পর্শ না করে, গাছের গোড়ার অংশ কমপক্ষে ৮-১০
সেন্টিমিটার ফাঁকা থাকবে।
রোগ ও পোকামাকড়ের পরিচর্যা :
বাড রট/কুঁড়ি পচা : রোগের প্রাথমিক অবস্থায় প্রতি লিটার পানিতে
৪-৫ গ্রাম প্রোপাকোনাজল ও ম্যানকোজেব গ্রুপের রোগনাশক মিশিয়ে কুঁড়ির গোড়ায়
স্প্রে করতে হবে ২১ দিন পরপর ২-৩ বার।
ফল পচা : প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে ম্যানকোজেব গ্রুপের
রোগনাশক মিশিয়ে আক্রান্ত ফলে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।
পাতার ব্লাইট : পরিমিত সার প্রয়োগ করলে ও যথাসময়ে সেচ এবং
নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে রোগের আক্রমণ কম হবে। আক্রমণ বেশি হলে
প্রোপাকোনাজল গ্রুপের রোগনাশক ১৫ দিন পরপর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
গণ্ডার পোকা : আক্রান্ত গাছের ছিদ্র পথে লোহার শিক ঢুকিয়ে সহজেই
পোকা বের করে মারা যায়। ছিদ্র পথে সিরিঞ্জ দিয়ে অরগানো ফসফরাস গ্রুপের
কীটনাশক প্রবেশ করায়ে ছিদ্রের মুখ
আঠালো মাটি দ্বারা বন্ধ করে দিলে পোকা মারা যায়।
নারকেলের মাইট : উদ্ভিদজাত বালাইনাশক
বাইকাও ২ মিলি/লি. পানি ব্যবহার করা। আক্রমণ বেশি হলে আক্রান্ত ফলসহ অন্যান্য অংশ
পরিষ্কার করে অনুমোদিত মাকড়নাশক ব্যবহার করা। প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম থিওভিট
বা ২ মিলি ওমাইট বা ২ মিলি ডেনিটল, বার্টিমেক ১.২৫ মিলি মিশিয়ে ১৫ দিন
পরপর ২/৩ বার স্প্রে করা। নারকেল গাছের গোড়া থেকে দূর দিয়ে গর্ত করে শিকড় বের
করতে হবে। এরপর চারদিকের চারটি শিকড় কর্তন করে সেই শিকড়ের মাথায় ছোট পলিথিনে ২
মিলি মাকড়নাশক ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে বেঁধে দিতে হবে। এতে ডাবের গায়ের মাকড়
বেরিয়ে আসবে বা মারা
যাবে। এরপরে গাছে মাকড়নাশক স্প্রে
করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
0 Comments